শনিবার, ৩০ জুন, ২০১২

নতুন বাজেট_ সমস্যা ও সম্ভাবনা


এমএম আকাশ
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন ও ভর্তুকি ব্যয়ের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর মীমাংসা কীভাবে হয় এবং কোনদিকে ঝুঁকে পড়ে তার ওপর ভবিষ্যতের অনেক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্ক নির্ভর করবে।
তাহলে সামগ্রিকভাবে কী দাঁড়াল? অনেক টানাপড়েন ও চাপের মুখে এ বাজেট।
সরকার যদি লুটেরা ধনিক শ্রেণীর কাছ থেকে নির্মমভাবে কিছু রাজস্ব আদায় করতে পারে, তাহলে জনগণের ওপর বোঝা
না বাড়িয়ে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার সম্মানজনক
রাখা যেত


নতুন অর্থবছর ২০১২-১৩ আজ ১ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট পেশ করার পর এ নিয়ে সংসদের ভেতরে ও বাইরে অনেক আলোচনা হয়েছে। এ থেকে সাধারণভাবে যেসব মন্তব্য পত্রিকার পাঠক এবং টেলিভিশন ও আলোচনা সভার শ্রোতারা বারবার শুনেছেন, সেগুলো এভাবে তুলে ধরা যায়।
এক. এবারের বাজেট আকারে বড় এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা সরকারের নেই। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ বাংলাদেশের অর্থনীতি আকারে বড় হচ্ছে। আমাদের চাহিদা-প্রয়োজন বাড়ছে। সে তুলনায় বাজেট মোটেই বড় নয় এবং বাস্তবায়নযোগ্যও বটে।
দুই. বাজেটে আয় ও ব্যয়ের যে প্রস্তস্নাবনাই অর্থমন্ত্রী করুন না কেন; বছর শেষে সেটা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। রাজস্ব আয়ের যে হিসাব করা হয়েছে, তা আদায় হবে না। রাজস্ব ব্যয়ও বেড়ে যাবে। ফলে উদ্বৃত্ত কমবে। বিদেশি সাহায্য কম পাওয়া যাবে অথবা তার ব্যবহারের হার কমে যাবে। সুতরাং প্রস্তস্নাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পূরণ হবে না। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ আমাদের রাজস্ব বিভাগ গত কয়েক বছরে প্রচুর দক্ষতা দেখিয়েছে এবং সেটা আরও বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ কারণে রাজস্ব্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা পূরণ করায় সমস্যা হবে না।
তিন. বিদেশি দাতা অর্থাৎ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থ্থা ও দাতাদের সঙ্গে সরকারের যে মতবিরোধ চলছে, তার প্রভাবে বিদেশি সাহায্য কম আসবে। সরকার বাধ্য হবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করতে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পাবে না। বিপরীতে সরকারের বক্তব্য_ সার্বিকভাবে এ বছরের বাজেটে রাজস্ব্ব ঘাটতি জিডিপির ৫ দশমিক ১ শতাংশ। সুতরাং এটা প্রচলিত ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অতএব, চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।
চার. বহুল বিতর্কিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকির চাপ কমবে না। ভর্তুকি না দিলে বা অনেক পরিমাণে কমিয়ে আনতে হলে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়াতে হবে। তার ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। যেহেতু সাধারণ নির্বাচন সনি্নম্নকটবর্তী হচ্ছে এবং সে কারণে এ বছরটি সরকারের পুনর্নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেহেতু মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি সরকারের জন্য নেওয়া কঠিন। কিন্তু পরিস্থি্থতি তো শাঁখের করাতের মতো। যদি সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তাকে বর্ধিত ভর্তুকির সংস্থান করতে হবে। সেটা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বা টাকা ছাপিয়ে করলে মুদ্রাস্ফীতি আবারও ঊর্ধ্বমুখী হবে। সরকারের তাই চয়েজ থাকবে কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন কিংবা ডিমান্ড-পুল ইনফ্লেশন_ কোনো একটি বেছে নেওয়া। অর্থাৎ ইনফ্লেশনের চাপ থাকছেই। সংযত মুদ্রানীতি দিয়ে এই সমস্যা কিছুটা ট্যাক্ল করা সম্ভব। কিন্তু তাতে প্রবৃদ্ধির হার আবার কিছুটা হ্রাস পাবে। গত ২০১১-১২ অর্থবছরের শেষদিকে সরকার সংযত মুদ্রানীতি অনুসরণ করে (অর্থাৎ ঋণপ্রবাহ সংকোচন ও সুদের হার বৃদ্ধি) মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সে জন্য তাকে মূল্য দিতে হয়েছে_ প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশ থেকে খানিকটা কম (৬ দশমিক ৩ শতাংশ) মেনে নিতে হয়েছে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি কমাতে সংযত মুদ্রানীতি নিলে তার প্রতিকূল প্রবৃদ্ধি প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সরকারের সমর্থকদেরও কেউ কেউ ঘরের ভেতরের আলোচনায় স্বীকার করেন, মুদ্রাস্ফীতির বিপদ প্রবৃদ্ধি কমার বিপদের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। গত বছর প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমলেও অন্য দেশের মান-এ যেহেতু এ হার সম্মানজনক ছিল এবং আগামীতে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, তাই এ বিষয়টি নিয়ে তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নেই।
পাঁচ. সমালোচকরা বলেন, বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু এ জন্য সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিপরীতে সরকারের জবাব, আমরা তো মানুষকে বিদ্যুৎ দিয়েছি। দাম একটু বেশি পড়েছে, তবু অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দাম অনেক কম।
এবারে বাজেটের মোট আয়তন প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বিভিন্ন হিসাব থেকে আমরা দেখছি যে, নতুন এই বছরে জিডিপির সম্ভাব্য আয়তন ধরা হয়েছে ১০ লাখ ৪১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা এবং বিদায়ী বছরে প্রাক্কলিত (সংশোধিত) জিডিপি ছিল ৯ লাখ ১৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এই হিসাব অনুসারে যদি ধরে নিই, জিডিপি বৃদ্ধির নমিনাল হার ২০১২-১৩ অর্থবছরে হবে টাকার অঙ্কে ১৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং মুদ্রাস্ফীতির হার অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত ৭ দশমিক ৫ শতাংশই থাকবে; তাহলে বলা যায়, জিডিপি বৃদ্ধির প্রকৃত হার হবে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে বিদায়ী বছরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। অতএব এখানে নিঃসন্দেহে একটি গরমিল আছে। কিন্তু সব মিলিয়ে বলা যায়, এ প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। তাতে অবশ্য বর্তমান বিশ্ব ও আশপাশের দেশের মান-এ খুব অখুশি হওয়ার কিছু নেই। সরকারি বাজেট জিডিপির ১৮ শতাংশের মতো। এটাও একটি স্ট্যান্ডার্ড প্যারামিটার। সেই হিসাবে আমি মনে করি না যে, বাজেট উচ্চাভিলাষী। কিন্তু যেটা সরকার স্ব্বীকার করেনি তা হচ্ছে, সরকারের হিসাবই প্রবৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং এটা বাস্তবায়িত না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
প্রতিটি বাজেটেই আয় ও ব্যয় সম্পর্কে কতগুলো পূর্বানুমান থাকে। এটা বাস্তস্নবসম্মত না হলে পুরো বাজেট ওলটপালট হয়ে যায়। এ কারণে প্রস্তাবিত বাজেটের চেয়ে সংশোধিত বাজেট অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। আমরা যদি গত বছরের বাজেট প্রস্তাব ও সংশোধিত হওয়ার পরের পরিসংখ্যান তুলনা করি, তাহলে এটা সহজেই বুঝতে পারব। ২০১১-১২ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। আদায় হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধনের মাত্রা ছিল প্রায় (-) ৩ শতাংশ। অন্যদিকে, রাজস্ব ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৭ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত ব্যয়ের পরিমাণ ৯১ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধন হয়েছে প্রায় (+) ৫ শতাংশ। এ প্রবণতা দীর্ঘকালীন। অর্থাৎ সচরাচর আমরা যে আয়ের হিসাব দিই, আয় করি তার চেয়ে কম এবং ব্যয়ের যে হিসাব দিই, প্রকৃত ব্যয় করি তার চেয়ে বেশি। ফলে রাজস্ব উদ্বৃৃত্ত কমে যায় এবং শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করি। এভাবে আমরা বর্তমানের স্বার্থে ভবিষ্যৎকে জলাঞ্জলি দিই। গত অর্থবছরেও তাই হয়েছে। ওই বছর প্রস্তাবিত উন্নম্নয়ন ব্যয় ছিল ৫৫ হাজার ৬৪২ কোটি টাকা। সংশোধিত ব্যয় হয়েছে ৪৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় প্রস্তাবের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। আমার অনুমান, নতুন বছরেও এমনটি ঘটবে। এ থেকে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জিত হবে না। সরকার বলতে পারে যে, সরকারি খাতে বিনিয়োগ কমলেও বেসরকারি খাত সেটা পুষিয়ে দেবে। কিন্তু পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপির করুণ পরিণতি এবং এ যাবৎকালের প্রবণতা এর বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। কোনোক্রমে যদি আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য আরও বেড়ে যায় (যদিও গত কয়েক দিনে দাম কিছুটা কমার প্রবণতা লক্ষণীয়), তখন সরকার যে 'সহনীয়' ভর্তুকির মাত্রার কথা বলছে, সেটুকু দিতেই সম্ভাব্য কোষাগারে টান পড়বে। এ অবস্থায় সরকারকে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়াতে হবে কিংবা বাইরে থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। সরকার অবশ্য ৫ থেকে ৭ শতাংশ সুদে 'সভরেন বন্ড'-এর কথা বলছে। এর অর্থ বিদেশি পুঁজিবাজারে বন্ড ছেড়ে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের চেষ্টা করা। তবে এটা হচ্ছে সরকারের শেষ অপশন। প্রথমে তারা চেষ্টা করবে বিদেশি সাহায্যসূত্রে অর্থ সংগ্রহ করতে। তার পরে অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে এবং সবশেষে সভরেন বন্ড থেকে। সম্ভাব্য ঝুঁকি ও বিকল্প অর্থায়নের 'অপশন' হিসেবে এসব উৎসের কথা অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। এ জন্য আবারও বলব, অত্যন্ত চাপের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হবে এ বছরের বাজেট বাস্তবায়ন। তবে সরকার যদি প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারে, রফতানি খাতে সহসা আর যদি কোনো চাপ না পড়ে এবং পাইপলাইনে রয়ে যাওয়া বিদেশি সাহায্য ব্যবহারের মাত্রা যদি আরও কার্যকর করা যায়, তাহলে এসব ঝুঁকি কিছুটা কমতে পারে।
বিদায়ী বছরের বাজেটে বৈদেশিক সাহায্যের প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৭ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা। সংশোধিত হিসাবে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ১১ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ৩৪ শতাংশ কম! এ বছরে সরকার চাইছে ১৮ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা। এর অর্থ দাঁড়াবে, গত বছরে প্রস্তস্নাবের তুলনায় প্রায় ৩৪ শতাংশ হ্রাসের পর যা সরকার পেয়েছে, সে তুলনায় নতুন বছরে প্রায় ৫৬ শতাংশ বাড়তি সাহায্য সংগ্রহের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রস্তাব কার্যকর করতে হলে দাতাদের সব পরামর্শ গিলতে হবে। কিন্তু এসব তিক্ত বটিকা গিললে পরিণতি কী হয় তার উদাহরণ ইন্দোনেশিয়া; যাকে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ স্টিলগিৎজ বলেছেন 'আইএমএফ রায়ট'। আর যদি গিলতে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে সরকারকে মৌলিকভাবে নতুন করে ভাবতে হবে।
নির্বাচনী বছরের নিকটবর্তী অর্থবছরে সরকার কী করবে? প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের জন্য অর্থায়নের মাত্রা দাতাদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের ওপর অনেকখানি নির্ভর করছে। তবে বলতে পারি যে, এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সংকেত দাতাদের দিক থেকে শুভ নয়।
সরকারের বিদ্যুৎ খাতের যে পরিকল্পনা তাতে দেখা যায় এপ্রিল, ২০১২ পর্যন্ত মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৪ শতাংশ উৎপাদন করেছে সরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বাকি ৪৬ শতাংশ এসেছে বেসরকারি খাতের প্ল্যান্ট থেকে। আগামী চার বছরে অর্থাৎ ২০১৬ সাল নাগাদ মোট যে ১৪ হাজার ৭৭৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে ৫৮ শতাংশের জোগান আসবে বেসরকারি খাত থেকে এবং ৪২ শতাংশ উৎপাদন করা হবে সরকারি প্ল্যান্টে। অর্থাৎ সরকার ক্রমবর্ধমান হারে বেসরকারি খাতের দিকে ঝুঁকছে। বেসরকারি খাত দয়াদাক্ষিণ্য দেখাতে আসে না। তারা পুঁজির ওপর নির্ধারিত অঙ্কে মুনাফা অর্জনে সচেষ্ট হবে। সুতরাং দাম বৃদ্ধি অনিবার্য হবে। তবে বিদ্যুৎ তৈরির ব্যয় নির্ভর করে কোন ধরনের জ্ব্বালানি ব্যবহার করা হবে তার ওপর। ২০১২ সালের প্রথম দিকের হিসাবে দেখা যায়, ১৭ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল ব্যবহার করে। এ ধরনের প্ল্যান্টের উৎপাদন ব্যয় কয়লা, গ্যাস ও পানির প্ল্যান্টের তুলনায় অনেক বেশি পড়ে। উল্লেখ করা দরকার, বর্তমানে বাংলাদেশে ৭৮ শতাংশ বিদ্যুৎ প্রকল্পে জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের ব্যবহার হয়ে থাকে।
এখন থেকে যে নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে তার কতটা গ্যাস, কয়লা বা পানি এবং কতটা জ্বালানি তেল ব্যবহার করে_ তার ওপর ভবিষ্যতের মূল্য পরিস্থিতি ও সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ এবং অর্থনীতির সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ প্রাপ্তি ও প্রতিযোগিতার ক্ষমতা ইত্যাদি বিষয় নির্ভর করবে। কেউ কেউ বলেন, বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে, কয়লা আমদানি করে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প চালু হবে, নতুন গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাসের জোগান দেওয়া হবে বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে এবং পানি-বায়ু-আলো ব্যবহার করে বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ করা হবে। সুতরাং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ মিলবে। এ সম্ভাবনা আমি অসম্ভব মনে করি না। কিন্তু এসব পদক্ষেপ তো ব্যক্তি খাত বা বেসরকারি খাত নেবে না। যেহেতু সরকারের মনোবীক্ষণে ব্যক্তি খাত এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীর আধিক্য, সেহেতু এসব নন-ট্রাডিশনাল উদ্যোগে সরকার না ঝুঁকলে কপালে দুঃখ আছে। সরকারের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত রোডম্যাপ থেকে জানা যায়, এ খাতে এ বছর ৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। জ্বালানি খাতেও প্রায় সমপরিমাণ ভর্তুকির পরিকল্পনার উল্লেখ রোডম্যাপে ছিল। কিন্তু বাজেট দেখে এ ভর্তুকি কোত্থেকে আসবে, সেটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় না। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল যেহেতু এ খাতে আর কোনো ভর্তুকি প্রদান নিষিদ্ধ করেছে, সুতরাং বাড়তি অর্থ হয়তো সরকার ঋণ হিসেবে দেবে। এ অবস্থায় দাম বৃদ্ধি অনিবার্য এবং তা কি সহনীয় মাত্রায় থাকবে? নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা এবং সেখানে উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ দেখানো হয়েছে প্রায় ৯ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হচ্ছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন ও ভর্তুকি ব্যয়ের দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর মীমাংসা কীভাবে হয় এবং কোনদিকে ঝুঁকে পড়ে তার ওপর ভবিষ্যতের অনেক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অঙ্ক নির্ভর করবে।
তাহলে সামগ্রিকভাবে কী দাঁড়াল? অনেক টানাপড়েন ও চাপের মুখে এ বাজেট। সরকার যদি লুটেরা ধনিক শ্রেণীর কাছ থেকে নির্মমভাবে কিছু রাজস্ব আদায় করতে পারে, তাহলে জনগণের ওপর বোঝা না বাড়িয়ে, মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে প্রবৃদ্ধির হার সম্মানজনক রাখা যেত। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার আমজনতার ওপর মোবাইল রিচার্জ কর আরোপ এবং ব্যাংকের সুদের ওপর কর বসিয়ে নিজেকেই হাস্যাস্পদ করেছিল। অবশ্য দুষ্ট লোকেরা বলে, বাজেটের মূল বিষয়গুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতেই এসব প্রস্তাব সুচিন্তিতভাবে রাখা হয়। কিন্তু সরকারকে মনে রাখতে হবে, তারা উটপাখি নয়। বালুর নিচে মুখ লুকিয়ে রাখলেই ঝড় আসা বন্ধ হবে না। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কল্যাণমূলক পুঁজিবাজারের রাস্তা নিলে দাতাদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরও বাড়বে। কিন্তু জনসমর্থনের নিরিখে পরবর্তী নির্বাচনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। কোন পথ সরকার বেছে নেয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকব।

ড. এমএম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শনিবার, ২৬ মে, ২০১২

বাজেট ২০১২ :মুদ্রাস্ফীতি না প্রবৃদ্ধি কোনটি বেছে নেবেন অর্থমন্ত্রী


এমএম আকাশ
অপচয় কমানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ, যারা করদানে সক্ষম তাদের কাছ থেকে কর আদায় সর্বোপরি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের নীতি অনুসরণ না করলে বর্তমান কঠিন অবস্থা থেকে উদ্ধার মিলবে না। যত দ্রুত সম্ভব কুইক রেন্টাল থেকে বের হয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। এসবের জন্য আমাদের বেশি বৈদেশিক সাহায্যের দরকার নেই। যে সাহায্য পাইপলাইনে রয়ে গেছে, তা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করাই যথেষ্ট হবে



আরেকটি বাজেট পেশের সময় চলে এলো। এবারের বাজেটের বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটা হচ্ছে ঘনীভূত সম্পদ ঘাটতি এবং সম্পদপ্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তা। ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে, নতুন বছরের বাজেট হবে আনুমানিক ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার, যা চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের চেয়ে ১৬ শতাংশের মতো বেশি। তবে এখানে ফাঁকি রয়েছে। বিদায়ী বছরের বাজেটে সরকার ভর্তুকির যে হিসাব করেছিল, তা অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকায় পেঁৗছেছে। যদিও অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি স্বীকার করেন, এ অপ্রত্যাশিত ব্যয় বৃদ্ধি হতো না, যদি তারা কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত না নিতেন। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যে হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে এবং বেড়ে গেলে যে সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যেতে পারে_ এ কথা কিন্তু অর্থমন্ত্রীর চলতি বছরের বাজেট ভাষণের এক স্থানে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে ওলটপালট হয়ে গেলে কী করা হবে, সে বিষয়ে বাজেটে কোনো পরিকল্পনা উপস্থিত করা হয়নি। অর্থমন্ত্রী এক আলোচনায় স্বীকার করেছেন, কুইক রেন্টালের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত আরও ভেবেচিন্তে নিলে ভালো হতো। যাই হোক, ৪০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির পুরোটা বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে সংস্থান করা সম্ভব হয়নি। ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েও পুরোপুরি মেটানো যায়নি। বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েও ভর্তুকির আকার খুব একটা কমানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত সরকার বাধ্য হয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির চাপ আগামী অর্থবছরের কাঁধে তুলে দিতে চাইছে। সুতরাং ওই বোঝাটি বাদ দিয়ে এ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বাস্তবে হবে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। টাকার হিসাবে আগের বছরের তুলনায় বাড়বে মোটামুটি মাত্র ১২ শতাংশ!
কিন্তু আমরা জানি যে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (১০ শতাংশ বা তার বেশি)। তাহলে প্রকৃত মূল্যে বাজেটের আয়তন বাড়বে খুবই নগণ্য অর্থাৎ মাত্র ২ শতাংশ। সুতরাং অর্থমন্ত্রীকে ভাবতে হবে যে, এই স্বল্প বৃদ্ধির বাজেট দিয়ে তিনি শ্যাম, না কুল_ কোনটা রাখবেন।
আগামী বছরে যদি জ্বালানি তেলের দাম সহসা বৃদ্ধি পায় এবং সরকার যদি দ্রুত কুইক রেন্টাল থেকে সরে এসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে যেতে না পারে, তাহলে হয় তাকে আরও বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে, না হয় বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে বিপুলভাবে বাড়াতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে আর কি সম্ভব? বাজেটে কি তার জন্য বাড়তি অর্থ রাখা হয়েছে কিংবা হবে? নতুন বছরের বাজেট আকার থেকে মনে হয়, সরকার ঠিক করে রেখেছে যে, আর ভর্তুকি নয়। এমনকি এ আকারের বাজেট প্রণয়নের জন্যই সরকারকে এখন আইএমএফ ও অন্য দাতাদের কাছে ধর্ণা দিতে হয়েছে। আর আমরা জানি যে, আইএমএফ যখন টাকা দেয়, তখন তারা প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে চিন্তিত থাকে না। চিন্তিত থাকে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। এ বছরেও তা-ই হয়েছে। তাদের শর্ত সম্পর্কে যতটা জেনেছি, দেখা যায় ভর্তুকি কমাতে বলা হয়েছে এবং বিশেষ করে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। সরকার এ তিক্ত বটিকা গলাধঃকরণ করতে বাধ্য হয়েছে। কোমরের বেল্ট যতই কষে বেঁধে ব্যয় কমানোর চেষ্টা হোক না কেন, মূল্যস্ফীতি কি তাতে কমবে? বিশ্বে যেখানে যেখানে আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কাজ হয়েছে সেখানেই দেখেছি_ জোসেফ স্টিগলিৎসের ভাষায় 'ওগঋ জওঙঞ'. এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ইন্দোনেশিয়া। কৃষিসহ অন্য সব সামাজিক খাত থেকে যদি আমরা ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হই, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি ইত্যাদি পাবলিক ইউটিলিটির দাম যদি বেড়ে যায়, পরিবহন ব্যয় যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য বেড়ে যাবে। আমরা যদি আইএমএফের কথা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়াই, তাতেও উৎপাদন খরচ বাড়বে। যদি টাকার অবমূল্যায়ন হয় তাহলেও আমদানি দ্রব্যের দাম বেড়ে যাবে। এতগুলো দাম বৃদ্ধির সম্মিলিত চাপে মূল্যস্ফীতিকে কি আমরা প্রতিরোধ করতে পারব? সুতরাং মূল্যস্ফীতি প্রতিরোধ করতে কেবল ব্যয় সংকোচনের পথে আমরা অগ্রসর হতে পারি না। আমাদের উৎপাদনের দক্ষতা বাড়িয়ে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে, জিডিপি বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সরকার যদি মনে করে থাকে, আইএমএফের একরোখা নীতি অনুসরণ করে মুদ্রাস্ফীতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে, তাহলে বোকার স্বর্গে বাস করা হচ্ছে বলে ধরে নিতে হবে। এটা করতে গিয়ে যা হবে, তা হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতিও কমবে না, প্রবৃদ্ধিও হ্রাস পাবে।
এ বছর প্রবৃদ্ধির হার কী হবে, সেটা কে জানে? 'বন্ধু আইএমএফ' বলে দিয়েছে, এটা হবে ৫ দশমিক ৫%। 'আরেক বন্ধু' এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে ৬ দশমিক ২%। 'অপর বন্ধু' বিশ্বব্যাংক বলছে ৬ শতাংশ। এ হার যা-ই হোক না কেন, কোনোটাতেই সরকার সন্তুষ্ট হবে না। কারণ, তাদের লক্ষ্য ৭% এবং নতুন বছরের জন্য ধরা আছে ৭ দশমিক ৩%। কিন্তু ব্যাংক থেকে ভর্তুকি মেটাতে সরকার যে পরিমাণ ঋণ নিয়েছে, তাতে যে ক্রাউডিং আউট অ্যাফেক্ট হয়েছে, তার ফলে আশানুরূপ বেসরকারি বিনিয়োগ হয়নি বলেই উদ্যোক্তারা বলছেন। বিদ্যুৎ এবং অবকাঠামো ক্ষেত্রে যে সংকট ছিল, তার ফলেও নতুন শিল্পে বিনিয়োগ যথাযথ মাত্রায় হয়নি। কৃষি উৎপাদন, তৈরি পোশাক শিল্প রফতানি এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ যদি আরেকটু কম হারে বৃদ্ধি পেত, তাহলে এ বছর প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের নিচে থাকত_ তাতে সন্দেহ নেই। এসব থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের উচিত হবে প্রবৃদ্ধির হার অক্ষুণ্ন রাখার স্বার্থে এসব খাত থেকে আয় বাড়ানোর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিয়োগ করা। আইএমএফের কথা শুনে যদি এসব খাতে সরকারি ব্যয় কমানো হয়, তাহলে প্রবৃদ্ধির হার কিছুতেই ধরে রাখা সম্ভব হবে না। সুতরাং হরেদরে সুদের হার বাড়ানো বা ভর্তুকি কমানো মোটেই কাম্য হবে না। কৃষি খাত সরকারকে একটা সুবিধা দিয়েছে_ বাজারে খাদ্যশস্যের দাম কম। এটা কমিয়ে রাখা সরকারের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার জন্য জরুরি। সমাজের হতদরিদ্র ক্ষুধার্ত ২৫ শতাংশকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও এটা জরুরি। তবে ৩৫ টাকা দরেও দরিদ্ররা চাল কিনতে পারে না। সুতরাং তাদের জন্য বাজারবহির্ভূর্ত নিরাপত্তা ব্যয়ের যেসব কর্মসূচি রয়েছে, সেগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। পোশাক শিল্প খাতের জন্য প্রস্তাবিত রেশন ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রকৃত আয় ২ বছর আগের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কমেছে। সে জন্য ধূমায়িত অসন্তোষের লক্ষণও স্পষ্ট। দরকার হলে সরকারের ভাণ্ডারে অর্থ না থাকলে পোশাক শিল্পের মালিকদের মুনাফার যে ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করার কথা_ যা থেকে বছরে আনুমানিক ১৫০ থেকে ৩২০ কোটি টাকা মিলতে পারে, সেটা সংগ্রহ করে শ্রমিকদের জন্য বাসস্থান ও রেশন ব্যবস্থা চালু করা যায়। মনে রাখা দরকার, একবার যদি এ শিল্পে ধস নামে, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্য লেনদেনে সামগ্রিক ভারসাম্য আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়াতে আমরা যদি কৃষি উপকরণে ভর্তুকি না দিই; উচ্চমূল্যে ডিজেল, বীজ, সার কিনতে কৃষককে বাধ্য করি, তাহলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে এবং ধানের সংগ্রহমূল্য সরকার ঘোষিত প্রতি কেজি ১৮ টাকায় রাখলেও কৃষকের জন্য সেটা প্রণোদনামূলক হবে না। পরবর্তী বছরের উৎপাদনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির হারও তাতে কমবে। সুতরাং একদিকে সরকারের সামনে রয়েছে আইএমএফের পরামর্শ গ্রহণ করার ফলে প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া, অন্যদিকে বর্ধিত উৎপাদন ব্যয়জনিত মুদ্রাস্ফীতিও অক্ষুণ্ন থাকা। এভাবে দু'দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে সরকারের কিছুই করার থাকবে না। আর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে মুদ্রাস্টম্ফীতি সামান্য কমিয়ে প্রবৃদ্ধির ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
কিন্তু সরকার যদি একটা দিক অক্ষুণ্ন রাখতে চায়, তাহলে কোনদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত? আমার মতে, তাদের উচিত হবে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রতিই বেশি মনোযোগ প্রদান। একই সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে যথাসম্ভব সেই প্রবৃদ্ধি যেন হয় সমতাপূর্ণ। কেউ বলতে পারেন যে, আইএমএফের তিক্ত বটিকা গলাধঃকরণ না করলে বিদেশি সহায়তা কমে যাবে। এমনিতেই সরকারের হাতে সম্পদের অপ্রতুলতা। এ অবস্থায় বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো খাতে কীভাবে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সম্ভব হবে? কীভাবে সম্ভব হবে কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখা? কীভাবে সম্ভব হবে শ্রমজীবী ও হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল আরও প্রসারিত করা? আগের মতো সরকার যদি নতুন বছরেও ব্যাংক ঋণের আশ্রয় নেয় তাহলে তো ব্যক্তি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে প্রবৃদ্ধির হার কমবে এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে? অধিক মুদ্রাস্ফীতি অথবা কম প্রবৃদ্ধি_ যে জটিল ও দ্বিমুখী সমস্যার শাঁখের করাত সরকারের পা কাটছে, সেখানে দুই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথটি তাই অত সহজ নয়।
কঠিন পথ তথা দক্ষতা বাড়ানো ও সঞ্চয় বাড়ানোর কিছু দিক তুলে ধরে লেখার ইতি টানব।
সরকারি সঞ্চয় বৃদ্ধি পেতে পারে সরকারের যাবতীয় অপচয়মূলক ব্যয় কমিয়ে এবং করের ভিত্তি প্রসারিত করে বা করের হার বাড়িয়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সামনে বড় একটি সুযোগ সম্পদ করের সঠিক বাস্তবায়নের মধ্যে নিহিত। সরকারের কাছে নিশ্চয়ই কোটিপতি সম্পদশালীদের তালিকা রয়েছে। সম্ভবত এ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ তাদের আশপাশেই বিচরণ করে। এ রকম প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য সবাই সম্পদের হিসাব নিয়মিত প্রকাশ করবেন। সেটা দিয়েই সরকার শুরু করতে পারে। অর্থমন্ত্রী অনলাইনে কর দিয়েছেন। এটা ভালো খবর। কিন্তু প্রতিশ্রুতির বাকি অংশ বাকি ব্যক্তিরা কেন পূরণ করছেন না? আমরা জানি, প্রথমে দৃষ্টান্ত দিয়ে উৎসাহিত করা না গেলে যার সঙ্গে যেমন, তেমন আচরণ করতে হয়। দুঃখজনকভাবে আমরা দেখছি, সরকার উল্টো পথ ধরছে। যারা অতীতে কর ফাঁকি দিয়েছে, তাদের তোষণ করার জন্য কালো টাকা সাদা করার অনুমতি দিয়েছে। এভাবে যারা আয়কর দেবে না, তারাও জেনে গেছে যে, কর না দিলে বিপদ নেই। আগামী অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করা যাবে। এভাবে তো কর খাতে শৃঙ্খলা আনা যাবে না।
ব্যক্তি খাতে যে পুঁজি বিদ্যমান, তা নানাভাবে বিদেশ চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। বিশেষ করে রেমিট্যান্স বাবদ যে অর্থ আসে, সেটা বৈদেশিক মুদ্রায় আসে। এ অর্থ যারা বিদেশে রেখে দিতে চান, তারা বাংলাদেশে প্রাপককে টাকা দিয়ে ডলার-পাউন্ড-ইউরো বাইরে রেখে দেন। এখানেও লেনদেনে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা রয়েছে। শেয়ার মার্কেটে কেলেঙ্কারির কথা আমরা জানি। হঠাৎ ব্যক্তি খাতে ৯টি ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হলো। সেখানেও কোটিপতিরা টাকা খাটালেন। তারা কি কর দিয়ে টাকা সাদা করে বিনিয়োগ করেছেন? জানতে ইচ্ছা হয়_ এই টাকার উৎস কী এবং আদৌ তা সাদা কি?
সুতরাং অপচয় কমানো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ, যারা করদানে সক্ষম তাদের কাছ থেকে কর আদায় সর্বোপরি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনের নীতি অনুসরণ না করলে বর্তমান কঠিন অবস্থা থেকে উদ্ধার মিলবে না। যত দ্রুত সম্ভব কুইক রেন্টাল থেকে বের হয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যেতে হবে। এসবের জন্য আমাদের বেশি বৈদেশিক সাহায্যের দরকার নেই। যে সাহায্য পাইপলাইনে রয়ে গেছে, তা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করাই যথেষ্ট হবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার বাড়ানোর চেয়ে দক্ষ বাস্তবায়নের প্রতি নজর দিতে হবে। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা প্রদানের চেয়ে তাদের তৃণমূলে বিকেন্দ্রীকৃত বাজেট তৈরিতে আত্মনিয়োগ করতে বলুন। মানুষের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে, আগামী বছর উন্নয়ন বাজেটে তার এলাকার কোন জিনিসটি সে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চায়_ সেতু, স্কুল, মাঝারি শিল্প, না চালকল কিংবা হাসপাতাল? অথবা বিধবা ভাতা ও অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা জাল প্রসারিত করা? এলাকার জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী একটি বটম-আপ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা চাই। আমাদের অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার অনেক আগে তার লেখা বইয়ে যে ধরনের বটম-আপ পরিকল্পনা প্রণয়নের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন_ এ পর্যন্ত তিনটি বাজেট প্রণয়নে তা রক্ষায় তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু আর তো সময় নেই। দেড় বছর পর সাধারণ নির্বাচন। বিরোধী দল এক একটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যে ফারাক রয়েছে তা দেখাতে শুরু করবে। অবশ্য আমাদের বর্তমান প্রধান বিরোধী দল এতই অদক্ষ যে, এ সুযোগ তারা নিতে পারছে না। কিন্তু তারা একটা হট্টগোল বাধিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমেরিকা ও ভারতের সমর্থন পেলেও সেই হট্টগোল থামিয়ে দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। সে রকম রাজনৈতিক গোলযোগ শুরু হলে এমনিতেই যে কঠিন অবস্থা, আগামী বছর তা তরল হয়ে ছত্রাকার হয়ে ছড়িয়ে যেতে পারে।

এমএম আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

বিজয়ের চল্লিশতম বর্ষে সামনে তাকানো


M-M-Akash-Edited1111চল্লিশ বছর কম সময় নয়। আমাদের দেশের একজন শিশু এই সময়ে কৈশোর, যৌবন পার হয়ে জীবনের পরবর্তী অর্ধাংশ পাড়ি দেওয়ার মত পূর্ণতা ও সক্ষমতা অর্জন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা ফেলতে শুরু করে। এক স্থীতধী ভরাট সময় এই চল্লিশতম জীবন পর্বের সূচনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও লজ্জার বিষয় যে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও সেই ‘ছেলে মানুষই’ রয়ে গেল। শিশুদের মত এখনও আমরা বহুবছর আগের মীমাংসিত ছেলেবেলার বিষয়গুলি নিয়ে পুনরায় আত্মকলহে মেতে রয়েছি। আমরা এখনও তর্ক করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বড় না জিয়া বড়। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন না বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম না কি এটা ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছেন নাকি তা মাত্র দশ লক্ষ হবে। একটু কষ্ট করে ১৯৭২ সালের পর ১৯৭৩-এর প্রথম বিজয় দিবসে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত জেনারেল জিয়ার নিজের লেখাটি পড়লেই বোঝা যায় যে এসব তর্কগুলি কতখানি অর্থহীন এক তর্ক।
একটি শিশুর জন্মের ইতিহাস যেমন পিতা-মাতার মায়া-মমতায়-প্রেমে ঘেরা প্রবাহমান ইতিহাস–এতে যেমন রয়েছে জন্মমুহূর্তের বিস্ময়, আনন্দ, রোমাঞ্চ, তেমনি আমাদের বাংলাদেশের জন্মেরও একটি সুদীর্ঘ রোমাঞ্চকর বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস আছে। সেটা কি আমরা পড়ে দেখেছি? আমার জীবন বৃত্তান্ত কি আমি জানি? পলাশীর প্রান্তরে মোহনলাল ও মীর মদনরা লড়াই করেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে। ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন লড়াই করেছিলেন রিভলবার দিয়ে, তেভাগার লড়াকু কৃষক লড়াই করেছে ঢাল-বল্লম-শর্কীর সাহায্যে, তিতুমীরেরও বাঁশের কেল্লা ছিল, এসবই ছিল সেই একই স্বাধীনতার ও মুক্তির লড়াই।
পাকিস্তানের দীর্ঘ চব্বিশ বছর অসংখ্য গণআন্দোলনে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের শহীদ ছালাম-বরকত-জব্বার, ৬ দফা আন্দোলনের শ্রমিক–শহীদ মনু মিয়া, ৬৯-এর বালক–শহীদ মতিউর, সর্বশেষ ৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালি, এমনকি বিজয়ের শেষ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর প্রাণ দিয়েছেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান প্রতিভাবান বুদ্ধিজীবীরা নিরস্ত্র অবস্থায়। এ দেশেরই কুলাঙ্গার বিশ্বাসঘাতক গোলাম আযম-নিজামীর বদর বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে (ছাত্র!) ধরে নিয়ে গিয়ে অবর্ণনীয় পাশবিক নির্মম অত্যাচার করে একজন একজন করে হত্যা করেছে। কিন্তু সূর্যের মত উজ্জ্বল আর বৃক্ষের সবুজের মত চির নবীন স্বাধীনতাকে তার পরেও চাপা দিয়ে রাখতে পারেনি তারা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর আগে স্বমহিমায় পবিত্র ঊষার মত দীপ্তি ছড়াতে ছড়াতে সে জন্ম নিয়েছে সগর্বে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তো স্বাধীনতার নয়, দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার অভিভাবকদের। আমরা স্বাধীনতার পিতা-মাতা অভিভাবকরাই আমাদের সন্তানকে ‘দুধে-ভাতে’ রাখা তো দূরের কথা, এমনকি তার যে নিজস্ব স্বাভাবিক বিকাশ সেটিই আমরা ব্যাহত ও বিকৃত করে ফেলেছি। রোগ থেকে, বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে পারিনি আপন সন্তানকে। আজ আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে বলতে চাই, আমাদের তাই দুটি লড়াই এক সঙ্গে চালাতে হবে।
আমাদের ‘ছেলেটাকে’ যেভাবে বিকলাঙ্গ করা হয়েছে, যেভাবে তার ভেতরে নানা মিথ্যা বচনের (Discourse) বীজানু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, পুরনো অমীমাংসিত বিতর্কের গিট্টু দিয়ে তাকে যেমন অতীত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে, তা থেকে আমাদের চিরতরে বের হয়ে আসতে হবে। এটি আমাদের প্রথম সংগ্রাম। অসমাপ্ত সংগ্রামকে সমাপ্ত করার সংগ্রাম। এর দুটি পরস্পর সংযুক্ত যমজ লক্ষ্য রয়েছে। আমাদের ’৭২-এর সংবিধান যা আমরা অর্জন করেছিলাম এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে তাকে অবিকৃতভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই সাথে পুরানো আঁস্তাকুড়ের থেকে উঠে আসা স্বাধীনতা বিরোধী শক্রদের পরাস্ত করে যোগ্য সাজা দিয়ে তাদেরকে চিরতরে এদেশ থেকে নির্মূল করতে হবে। এই বিপজ্জনক অসুখগুলি যেন আর কখনো আমার স্বাধীনতাকে খাঁমচে ধরতে না পারে সেজন্য একটি কঠিন কঠোর দৃঢ় সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রাম আমাদের চালাতে হবে। ঠিকমত এই সংগ্রাম চালাতে পারলে সমগ্র বিশ্বমানবতাকে আমরা এই সংগ্রামে আমাদের পাশে পাব, যেমন আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু আরেকটি দ্বিতীয় সংগ্রামও আমাদের সামনে রয়েছে, তা হচ্ছে সুস্থ সংহত স্বাধীনতাকে জনগণের জীবনে তাৎপর্যবহ অর্থবহ করার সংগ্রাম। শুধু রোগমুক্ত হয়ে যেমন আমরা খুশী হতে পারি না, শুধু রোগ প্রতিরোধক শক্তি অর্জন করাটাই যেমন মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়, যেমন পাশাপাশি দরকার স্বাস্থোজ্জ্বল সুন্দর এক জীবন উপভোগের প্রাচুর্য ও উচ্ছলতা তেমনি স্বাধীনতা সংহত করার মৌল কর্তব্যের পাশাপাশি আমাদের দরকার হবে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সংগ্রামেও জয়ী হওয়া। এটি ছাড়া প্রথম বিজয়টি টেঁকসই হবে না। আমার সন্তান শুধু জন্ম গ্রহণ করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকলেই চলবে না, তাকে বেঁচে থাকতে হবে ‘দুধে-ভাতে’।
আমরা এমন বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই যেখানে তার ১৬ কোটি অভিভাবক এবং আরো কোটি কোটি অনাগত অভিভাবকরা বুকে হাত দিয়ে নিশ্চিন্তে বলতে পারবেন এবং বলতে থাকবেন এই বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। এখানে কেউ না খেয়ে ঘুমাতে যায় না, এখানে কোন শিশু খাদ্যের অভাবে অকাল মৃত্যুবরণ করে না, কোন লোক রাস্তায় ঘুমায় না, এখানে ফসল ভরা ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কৃষকরা দাম না পাওয়ার আশংকায় ম্রিয়মান হয় না। এখানে শ্রমিকরা কারখানার বাঁশি বাজলে আরেকবার শরীর নিংড়ানো শোষণের কথা ভেবে শিউরে ওঠে না। এখানে বুদ্ধিজীবীর কলমের ঝরনা কোন অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের ভ্রুকুটির ভয়ে বা কোন পদের লোভে থমকে দাঁড়ায় না। এখানে আমরা ভাল আছি- ভাল থাকবো এবং প্রতিদিন ভবিষ্যতের কাছে এমন একটি সমাজের স্বপ্ন মধুর চিঠি পাঠিয়ে যাব যাতে লেখা থাকবে শুধু দেশের স্বাধীনতার কথা নয়, দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রতিটি ব্যক্তির অসীম স্বাধীনতা ও অসীম মুক্তির কথা।
বিজয়ের চল্লিশতম বর্ষে আমরা সেই দিকেই তাকিয়ে আছি। বিজয়কে আমরা সংহত করতে চাই। বিজয়কে আমরা এগিয়ে নিতে চাই।

এম. এম. আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিবাদ : কিছু প্রাথমিক মন্তব্য


M-M-Akash-Edited111
পৃথিবী বদলে যাচ্ছে–একদম নতুন ধরনের ঘটনা ঘটছে পৃথিবীতে। তিউনিসিয়ায় একজন শিক্ষিত যুবক তার মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য (অর্থনৈতিক আয় বা নিরাপত্তার জন্য নয়) নিজের শরীরে আগুন জালিয়ে আত্মহত্যার পর সে আগুন সারা আরব বিশ্বে একের পর এক ছড়িয়ে পড়ল। অবিশ্বাস্য দ্রুত বেগে তা ছড়ালো। আবার একই সাথে বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রাণভোমরা আমেরিকান ফিন্যান্স পুঁজির সিংহাসন দখলের জন্য মাত্র শতাধিক নানারকম আমেরিকান মানুষ (যাদের মধ্যে প্রাক্তন বামপন্থী, কালো-সাদা, মানবাধিকারকর্মী, বেকার যুবকসহ গায়ক, বাদক সবাইই আছেন!) শ্লোগান তুললেন “ওয়ালস্ট্রিট দখল কর” আর সেই ডাক ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। পৃথিবীর ৯৫১টি শহরে (এমনকি আমাদের ঢাকাতেও!) হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ জনগণ পথে নেমে ঘোষণা করলেন: পৃথিবীতে আজ যে ১ শতাংশ ক্ষমতাধর ধনী পুঁজিপতি রয়েছেন তাদেরকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। গণতন্ত্র হবে ৯৯ শতাংশের গণতন্ত্র। এর চেয়ে বিপ্লবী সহজ-সরল শ্লোগান গত পনের-বিশ বছরে এই জরাজীর্ণ বিবর্ণ সংকটজর্জর পৃথিবীতে এত সহজে আর উঠে আসেনি! তাই চমকে ভাবতে বসেছি একজন নিস্পৃহ সমাজবিজ্ঞানী এ সম্পর্কে প্রাথমিক কী কী পর্যবেক্ষণ পেশ করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে আমার এ সম্পর্কে মোট ১৬টি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে। পাঠকদের সঙ্গে ‘শেয়ার’ করার জন্য নিচে এগুলিকে তুলে ধরছি।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষণসমূহ
। প্রতিবাদটি শুরু হয়েছিল বিশ্ব পুঁজিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে। সেই কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমেরিকার “ওয়াল স্ট্রিট”। প্রধান শ্লোগান ছিল: “ওয়াল স্ট্রিল দখল কর!”
। প্রধান ইস্যু ছিল তিনটি: বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতি, বৈষম্য এবং বেকারত্ব। হয়তো এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওবামা প্রশাসনের লজ্জাকর দ্বিচারিতা: অপরাধী বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ‘বেইল আউট’ করে দরিদ্র নাগরিকদের সামাজিক ভোগ তহবিল সংকোচিত করার লজ্জাকর নীতিকৌশল।
। কোনো স্থায়ী সংগঠন বা বৃহৎ রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনকে সংগঠিত করে নি। এটা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত আত্মসংগঠিত একটি সামাজিক উদ্যোগ। এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরির কৌশল। এই সফল কৌশল এমন এক সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে যেখানে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন যে তিনিই এই আন্দোলনের কর্মী, তিনিই আবার এই আন্দোলনের জনক বা নেতা। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মত: “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”।
। এই আন্দোলনটি হচ্ছে আগের অন্য সকল বিপ্লবী আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের ভিন্নধর্মী একটি গণবিপ্লবী আন্দোলন। আগের সকল বিপ্লবী আন্দোলন তৈরি হয়েছে অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশের বা প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশের “দুর্বল গ্রন্থিতে” এবং তার নেতৃত্বে থেকেছে সদা সর্বদা একটি “অগ্রগামী” সংগঠিত রেজিমেন্টেড বাহিনী। এবার বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অগ্রগামী শ্রেণীর শ্রেণীসংগ্রাম নয়, নানা মানুষের মধ্যে যারা “সমমতের অধিকারী” তাদের একত্রিত বিদ্রোহই জন্ম দিয়েছে এই নতুন আন্দোলনের। আর আন্দোলনটি জন্ম নিয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে একই সঙ্গে প্রায় সব উন্নত পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশের শহরগুলিতে। আক্ষরিক অর্থেই এই গণ-আন্দোলনের মূল চারিত্র্য হচ্ছে–জনগণের জন্য, জনগণের এবং জনগণের দ্বারা।
। এই আন্দোলন অসম্ভব হতো যদি ওয়েবসাইট, ফেসবুক মাইক্রো ব্লগ ও টুইটার, ইত্যাদি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধার সমর্থন অনুপস্থিত থাকতো।
। এই আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে এর “নেতিবাচক” চরিত্র। নিঃসন্দেহে এই আন্দোলন হচ্ছে প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ। বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে একটি প্রতিবাদ বিন্দুতে এসে একত্রিত হয়েছেন। সে জন্য তাদের কোনো দীর্ঘমেয়াদী নিজস্ব যৌথ কর্মসূচী ছিল না। তারা জানতেন যে তারা পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে চান কিন্তু কী দিয়ে তা তারা এখনো জানেন না। যেহেতু এই আন্দোলন এখনো স্বতঃস্ফুর্ত, অপরিকল্পিত, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-ক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসরমান সেহেতু এর ভবিষ্যৎও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত। যে কোনো শক্ত সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি এই আন্দোলনের ভেতরে নোঙর ফেলে এর হালটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পথে এগিয়ে নিতে পারে। তাই এই আন্দোলনের পরিণতি শুভও হতে পারে, অশুভও হতে পারে। অথবা আরো পেছনেও সমাজকে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি নৈরাজ্যেও পরিণত হতে পারে।
। প্রতিবাদটি ছিল আসলে আমেরিকান ফিন্যান্স পুঁজির প্রতীক “ওয়াল স্ট্রিটের” বিরুদ্ধে। প্রতিবাদটি শুরু হয়েছিল প্রায় এক মাস আগে ১৭ সেপ্টেম্বরে যখন মাত্র দুইশত প্রতিবাদকারী ওয়াল স্ট্রিটের কাছে একটি পার্কে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন প্রথমে কর্তৃপক্ষ একে কোনো আমল দেন নি। কিন্তু জেদী প্রতিবাদকারীরা দিনের পর দিন তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। ধীরে ধীরে তাদের সমর্থন বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করেন যে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে তাদের সরে যেতে হবে। তারা ভয় না পেয়ে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। নিপীড়ন ও গ্রেপ্তারের সম্ভাবনাকে মেনে নিয়ে নৈতিক মানসিক বল নিয়ে অটল রইলেন। তখন কর্তৃপক্ষ এ যাত্রা পিছু হটতে বাধ্য হলো কারণ আইন অনুযায়ী তাদের সরানোর কোনো অধিকার রাষ্ট্রের নেই! এই ক্ষুদ্র বিজয়টি ইলেকট্রিক বার্তার মত সারা পৃথিবীতে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করল তারই পরিণতিতে এই দুইশত নাগরিক পৃথিবীব্যাপী ইতিহাসের স্রষ্টায় পরিণত হলেন।
। যেহেতু মূল প্রাথমিক শ্লোগানটি ছিল “ওয়াল স্ট্রিট দখল কর” সেহেতু এটি কোনো সংকীর্ণ ইস্যুভিত্তিক সংগ্রাম ছিল না। এটি ছিল ক্ষমতাসীন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার মত একটি বৈপ্লবিক সংগ্রাম। তাই একই ধারায় বৈপ্লবিক শ্লোগানগুলি উঠেছে একটার পর একটা–“দখল কর রোম”, “দখল কর টোকিও”, “দখল কর মাদ্রিদ”, ইত্যাদি। জনগণের কণ্ঠে এমন একটি মৌলিক প্রতীকী শ্লোগান এর আগে শোনা যায় নি।
। সকল সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী : আদিবাসী নারী, কাল বর্ণের মানুষ, সমকামী বা উভলিঙ্গ মানুষ, প্রাক্তন যুদ্ধফেরৎ সৈনিক, শান্তি সংগ্রামী, হরেক রকম লোকেরা এতে এসে যোগ দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা অন্তর দিয়ে এই আন্দোলন সমর্থন করেছেন। তদুপরি শাসক শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত সৎ এবং অসন্তুষ্ট প্রতিনিধিরাও এই আন্দোলনের পক্ষে কোথাও কোথাও অবস্থান নিয়েছেন। সিডনির আন্দোলনে সেখানকার ব্যবসায়ী ইউনিয়ন যোগ দিয়েছেন। তাইওয়ানে তাদের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী ‘সেমি কন্ডাক্টর ম্যানুফেকচারিং এসোসিয়েশনের’ সভাপতি স্বয়ং এই আন্দোলনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। বড় বড় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন অঙ্গনের জাতীয় তারকারা এই আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন।
১০। প্রথম এই আন্দোলনের ডাকটা এসেছিল “১৫ অক্টোবর নেট” নামক ওয়েবসাইট থেকে। কিন্তু বিশ্ব যেন তার সমস্ত আবেগ ও কল্পনাশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসেছিল এই ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য। এটি ছিল একটি স্বার্থক সময়োচিত আহবান। বাদক এবং বাদ্যযন্ত্র উভয়ই তৈরি ছিলেন পবসুরকে সহযোগিতার জন্য। যদিও মনে রাখতে হবে এখানে একই লোক একই সঙ্গে বাদক এবং বাদ্যযন্ত্র উভয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
১১। এই সমগ্র আন্দোলনের একমাত্র ইতিবাচক সাধারণ শ্লোগানটি হচ্ছে: জনগণের ক্ষমতায়ন চাই এবং চাই প্রকৃত গণতন্ত্র।
১২। আমরা জানি সীমা অতিক্রম করলে পরম সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও হিংস্র হয়ে ওঠে। এখানেও তাই হয়েছিল। আমেরিকার “বস্টন দখল কর” মিছিল যখন “রোজ কেনেডি গ্রীনওয়েতে” পৌঁছায় ঠিক তখন দুপুর একটা ত্রিশ মিনিটে শত শত পুলিশ তাদের উপর নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মোবাইল ক্যামেরা এবং ইউ-টিউবের বদৌলতে সেই হিংস্রতার চিত্র তখন বাংলাদেশেই আমরা ডেস্কটপে দেখতে পাচ্ছি এবং আমাদের মনেও ক্ষোভের আবেগ জমতে শুরু করেছে। আন্দোলনের গতিবেগ স্তিমিত না করে আরো জড়িয়ে এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে।
১৩। এই ঘটনার পরেই নিউয়র্কের আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা একটি “মিলিয়নেয়ার মার্চ” বা “কোটিপতিদের বিরুদ্ধে মার্চের” আয়োজন করবেন। প্রধানতঃ এখন ট্রেড-ইউনিয়ন বা শ্রমিক শ্রেণীর পরিবারগুলো এই সংগ্রামে এগিয়ে এসেছেন।
১৪। আজ এ কথা প্রমাণিত যে তারা গত অর্থনৈতিক সংকট থেকে ফায়দা লুটেছে। সেই সব বড় বড় বিনিয়োগ কোম্পানি ও ব্যাংকগুলিকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তার কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে অঢেল ভর্তুকি প্রদান করেছেন। সে জন্যই বর্তমান রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘাটতির মাত্রা দাঁড়িয়েছে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। বেচারা রাষ্ট্রপতি ওবামা ঘোষণা করেছেন যে কোনোভাবেই হোক প্রতিবছর তিনি ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বাজেট ঘাটতি কমাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে? ওবামা যেটা করছেন তা হচ্ছে ব্যাপকভাবে তিনি সরকারের শিক্ষা ব্যয়, স্বাস্থ্য ব্যয়, সামাজিক বীমা সমর্থন ব্যয়, ইত্যাদি খাতে বাজেট কমাচ্ছেন। আর এসব ব্যয় সংকোচন প্রধানতঃ আঘাত করছে আমেরিকার নিম্নবিত্ত জনগণকে। এই জায়গাতেই ধীরে ধীরে জমা হচ্ছে বিক্ষোভ–প্রতিবাদের ঢেউ।
১৫। এই নতুন সামাজিক আন্দোলনটি দেশে-দেশে এখন পর্যন্ত সরকার, দাতা সংস্থা বা কর্পোরেশনের আর্থিক সমর্থন থেকে মুক্ত রয়েছে। যদিও একে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করার জন্য অনেক শক্তিই এখন তৎপর হবে। নিপীড়ন একে দমন করতে না পারলেও, প্রলোভন তা পারতেও পারে।
১৬। সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে হয়তো এক নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। হয়তো একেই ভবিষ্যত বলা হবে “উত্তর-আধুনিক বিপ্লবের” এক নতুন যুগ। যা বা যেরকমই হোক না কেন, এ যুগের বিপ্লবের মর্মবাণী হবে সকল প্রকার অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিরোধিতা। গণতন্ত্রের অর্থ অবশ্য এখানে অনেক ব্যাপক হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রায়ন হবে এ যুগের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
এম. এম. আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর: ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা


M-M-Akash-Edited11ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছিল। বাতাসে খবরটা ছিল এ রকম, একাধিক চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের অনেকগুলো অমীমাংসিত সমস্যার জট খুলে যাবে। এই মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, সড়ক ও রেলপথে এই মুহূর্তে ট্রানজিট দেওয়া সম্ভব না হলেও নৌপথে ট্রানজিট বা করিডরের ব্যাপারে কিছু অগ্রগতি ঘটবে। এবং বহুপক্ষীয় কানেক্টিভিটি এবং দীর্ঘমেয়াদি সড়ক ও রেল ট্রানজিটের ব্যাপারে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হবে। এই মুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি না হলেও একটি নীতিকাঠামোর ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হবে। সীমান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হবে, সমুদ্রসীমা না হলেও অন্তত স্থলসীমার ব্যাপারটি নিষ্পত্তি হবে। তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ নিয়েও উভয় পক্ষ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবে।
কিন্তু যেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এলেন, ঠিক সেদিন সকাল থেকে একটার পর একটা নেতিবাচক সংবাদ গণমাধ্যমে আসতে থাকল। প্রথম এল তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কথা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হলেন না এবং সে দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরে এলেন না। আসলে পানির ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে খুবই জটিল বিষয়। অভিন্ন একটি নদী যখন দুই দেশের দীর্ঘ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন প্রতি পর্যায়ে উজানের মানুষের সঙ্গে ভাটির মানুষের দ্বন্দ্ব হয়। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেটুকু পানি পাবে, যেটুকু পানি উজানের দেশ ভারত ব্যবহার করার পর অবশিষ্ট থাকবে। আবার ভারতের মধ্যে উজানের রাজ্যগুলোর ব্যবহারের পর বাদবাকি পানি পশ্চিমবঙ্গ পাবে। তাদের অবশিষ্ট আবার পাবে বাংলাদেশ। সুতরাং সমাধান হচ্ছে, শুষ্ক মৌসুমে সমগ্র নদীর সব পানি ব্যবহারকারীর মধ্যে জনসংখ্যা, প্রয়োজন এবং সমতার নীতি বজায় রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ নদী ব্যবস্থাপনার চুক্তিতে উপনীত হওয়া। এ ধরনের জটিল সমস্যা চুক্তি করে সমাধানের জন্য প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সহানুভূতি, ন্যায়নীতি ও যুক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন। এ রকম একটি পূর্ণাঙ্গ খতিয়ান ভারতের সরকারও করে নি। বাংলাদেশ সরকারও অতি আশাবাদ নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরে অগ্রসর হয়েছিল। ফলে শেষ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি ভেস্তে গেল।
বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর না হলে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরও সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের লেনদেনের ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে জরুরি দাবি ছিল ট্রানজিট এবং নিরাপত্তা (বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের বাংলাদেশে স্থান না দেওয়া)। এবং বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রধান প্রত্যাশা ছিল, পানি এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধাগুলো দূর করা। যেহেতু এবার সামগ্রিক একটি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সে জন্য উভয় পক্ষই লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রেখেই অগ্রসর হতে চেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো দেশই খুব বেশি দিয়ে কম নিতে রাজি হবে না। তবে আমি মনে করি, সামগ্রিক নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আরও খতিয়ানের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে উভয়ের জন্য লাভজনক একটি চুক্তি করার দিকে অগ্রসর হতে হবে। পানির ক্ষেত্রে আমরা একটু বেশি লাভবান হব, আর ট্রানজিটের ক্ষেত্রে ভারত একটু বেশি লাভবান হবে– এ ধরনের সামগ্রিক ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানে আমাদের উপনীত হতে হবে।
সীমান্ত সমস্যা, ছিটমহল সমস্যা, বাণিজ্য, নানা রকম সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক বিনিময় ইত্যাদি ক্ষেত্রে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক রচনায় যেটুকু ঐকমত্য স্থাপিত হয়েছিল, তা এই বিশেষ সংকটের কারণে স্থগিত থাকুক বা ভেঙে যাক, সেটা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়।
সর্বশেষ ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, ট্রানজিট ও পানি ইস্যুতে কোন সুনির্দিষ্ট চুক্তি করা সম্ভব না হোলেও সীমান্ত, বানিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে কিছু চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে কিছু হতাশা সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের জনগন হাসিনা সরকারের ষ্ট্যন্ডে বিশেষত: শেষ মুহূর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের শক্তিশালী ভুমিকায় খুশিই হয়েছেন এবং হারানো জাতীয় ঐক্য কিছু পরিমাণে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আরো লক্ষ্যনীয় যে, ভারতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহ আমাদের এই কঠোর অবস্থানের জন্য আমাদেরকে দায়ি করেন নি, বরঞ্চ তারা ছিলেন কেন্দ্রীয় পানি মন্ত্রী ও পশ্চিম বংগের মূখ্যমন্ত্রী ”দিদি”-র ব্যাপারেই বেশী সমালোচনামুখর!
এ ঘটনার শিক্ষা এই– উপযুক্ত প্রস্তুতি এবং দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সবার মতামত ও অংশগ্রহণ ছাড়া হুট করে কেল্লা ফতে করার প্রবণতা কখনোই পূর্ণ সাফল্য দেয় না।

এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।