চল্লিশ বছর কম সময় নয়। আমাদের দেশের একজন শিশু এই সময়ে কৈশোর, যৌবন পার হয়ে জীবনের পরবর্তী অর্ধাংশ পাড়ি দেওয়ার মত পূর্ণতা ও সক্ষমতা অর্জন করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা ফেলতে শুরু করে। এক স্থীতধী ভরাট সময় এই চল্লিশতম জীবন পর্বের সূচনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও লজ্জার বিষয় যে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও সেই ‘ছেলে মানুষই’ রয়ে গেল। শিশুদের মত এখনও আমরা বহুবছর আগের মীমাংসিত ছেলেবেলার বিষয়গুলি নিয়ে পুনরায় আত্মকলহে মেতে রয়েছি। আমরা এখনও তর্ক করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বড় না জিয়া বড়। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন না বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষক ছিলেন। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম না কি এটা ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছেন নাকি তা মাত্র দশ লক্ষ হবে। একটু কষ্ট করে ১৯৭২ সালের পর ১৯৭৩-এর প্রথম বিজয় দিবসে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত জেনারেল জিয়ার নিজের লেখাটি পড়লেই বোঝা যায় যে এসব তর্কগুলি কতখানি অর্থহীন এক তর্ক।পাকিস্তানের দীর্ঘ চব্বিশ বছর অসংখ্য গণআন্দোলনে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের শহীদ ছালাম-বরকত-জব্বার, ৬ দফা আন্দোলনের শ্রমিক–শহীদ মনু মিয়া, ৬৯-এর বালক–শহীদ মতিউর, সর্বশেষ ৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ত্রিশ লক্ষ বাঙ্গালি, এমনকি বিজয়ের শেষ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর প্রাণ দিয়েছেন দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান প্রতিভাবান বুদ্ধিজীবীরা নিরস্ত্র অবস্থায়। এ দেশেরই কুলাঙ্গার বিশ্বাসঘাতক গোলাম আযম-নিজামীর বদর বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে (ছাত্র!) ধরে নিয়ে গিয়ে অবর্ণনীয় পাশবিক নির্মম অত্যাচার করে একজন একজন করে হত্যা করেছে। কিন্তু সূর্যের মত উজ্জ্বল আর বৃক্ষের সবুজের মত চির নবীন স্বাধীনতাকে তার পরেও চাপা দিয়ে রাখতে পারেনি তারা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর আগে স্বমহিমায় পবিত্র ঊষার মত দীপ্তি ছড়াতে ছড়াতে সে জন্ম নিয়েছে সগর্বে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তো স্বাধীনতার নয়, দুর্ভাগ্য স্বাধীনতার অভিভাবকদের। আমরা স্বাধীনতার পিতা-মাতা অভিভাবকরাই আমাদের সন্তানকে ‘দুধে-ভাতে’ রাখা তো দূরের কথা, এমনকি তার যে নিজস্ব স্বাভাবিক বিকাশ সেটিই আমরা ব্যাহত ও বিকৃত করে ফেলেছি। রোগ থেকে, বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে পারিনি আপন সন্তানকে। আজ আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে বলতে চাই, আমাদের তাই দুটি লড়াই এক সঙ্গে চালাতে হবে।
আমাদের ‘ছেলেটাকে’ যেভাবে বিকলাঙ্গ করা হয়েছে, যেভাবে তার ভেতরে নানা মিথ্যা বচনের (Discourse) বীজানু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, পুরনো অমীমাংসিত বিতর্কের গিট্টু দিয়ে তাকে যেমন অতীত খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে, তা থেকে আমাদের চিরতরে বের হয়ে আসতে হবে। এটি আমাদের প্রথম সংগ্রাম। অসমাপ্ত সংগ্রামকে সমাপ্ত করার সংগ্রাম। এর দুটি পরস্পর সংযুক্ত যমজ লক্ষ্য রয়েছে। আমাদের ’৭২-এর সংবিধান যা আমরা অর্জন করেছিলাম এক সমুদ্র রক্তের বিনিময়ে তাকে অবিকৃতভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই সাথে পুরানো আঁস্তাকুড়ের থেকে উঠে আসা স্বাধীনতা বিরোধী শক্রদের পরাস্ত করে যোগ্য সাজা দিয়ে তাদেরকে চিরতরে এদেশ থেকে নির্মূল করতে হবে। এই বিপজ্জনক অসুখগুলি যেন আর কখনো আমার স্বাধীনতাকে খাঁমচে ধরতে না পারে সেজন্য একটি কঠিন কঠোর দৃঢ় সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত সংগ্রাম আমাদের চালাতে হবে। ঠিকমত এই সংগ্রাম চালাতে পারলে সমগ্র বিশ্বমানবতাকে আমরা এই সংগ্রামে আমাদের পাশে পাব, যেমন আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পেয়েছিলাম। কিন্তু আরেকটি দ্বিতীয় সংগ্রামও আমাদের সামনে রয়েছে, তা হচ্ছে সুস্থ সংহত স্বাধীনতাকে জনগণের জীবনে তাৎপর্যবহ অর্থবহ করার সংগ্রাম। শুধু রোগমুক্ত হয়ে যেমন আমরা খুশী হতে পারি না, শুধু রোগ প্রতিরোধক শক্তি অর্জন করাটাই যেমন মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়, যেমন পাশাপাশি দরকার স্বাস্থোজ্জ্বল সুন্দর এক জীবন উপভোগের প্রাচুর্য ও উচ্ছলতা তেমনি স্বাধীনতা সংহত করার মৌল কর্তব্যের পাশাপাশি আমাদের দরকার হবে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সংগ্রামেও জয়ী হওয়া। এটি ছাড়া প্রথম বিজয়টি টেঁকসই হবে না। আমার সন্তান শুধু জন্ম গ্রহণ করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকলেই চলবে না, তাকে বেঁচে থাকতে হবে ‘দুধে-ভাতে’।
আমরা এমন বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই যেখানে তার ১৬ কোটি অভিভাবক এবং আরো কোটি কোটি অনাগত অভিভাবকরা বুকে হাত দিয়ে নিশ্চিন্তে বলতে পারবেন এবং বলতে থাকবেন এই বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। এখানে কেউ না খেয়ে ঘুমাতে যায় না, এখানে কোন শিশু খাদ্যের অভাবে অকাল মৃত্যুবরণ করে না, কোন লোক রাস্তায় ঘুমায় না, এখানে ফসল ভরা ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে কৃষকরা দাম না পাওয়ার আশংকায় ম্রিয়মান হয় না। এখানে শ্রমিকরা কারখানার বাঁশি বাজলে আরেকবার শরীর নিংড়ানো শোষণের কথা ভেবে শিউরে ওঠে না। এখানে বুদ্ধিজীবীর কলমের ঝরনা কোন অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের ভ্রুকুটির ভয়ে বা কোন পদের লোভে থমকে দাঁড়ায় না। এখানে আমরা ভাল আছি- ভাল থাকবো এবং প্রতিদিন ভবিষ্যতের কাছে এমন একটি সমাজের স্বপ্ন মধুর চিঠি পাঠিয়ে যাব যাতে লেখা থাকবে শুধু দেশের স্বাধীনতার কথা নয়, দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রতিটি ব্যক্তির অসীম স্বাধীনতা ও অসীম মুক্তির কথা।
বিজয়ের চল্লিশতম বর্ষে আমরা সেই দিকেই তাকিয়ে আছি। বিজয়কে আমরা সংহত করতে চাই। বিজয়কে আমরা এগিয়ে নিতে চাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন