বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর: ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা


M-M-Akash-Edited11ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছিল। বাতাসে খবরটা ছিল এ রকম, একাধিক চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের অনেকগুলো অমীমাংসিত সমস্যার জট খুলে যাবে। এই মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, সড়ক ও রেলপথে এই মুহূর্তে ট্রানজিট দেওয়া সম্ভব না হলেও নৌপথে ট্রানজিট বা করিডরের ব্যাপারে কিছু অগ্রগতি ঘটবে। এবং বহুপক্ষীয় কানেক্টিভিটি এবং দীর্ঘমেয়াদি সড়ক ও রেল ট্রানজিটের ব্যাপারে একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হবে। এই মুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি না হলেও একটি নীতিকাঠামোর ব্যাপারে উভয় পক্ষ একমত হবে। সীমান্ত সমস্যাগুলোর সমাধান হবে, সমুদ্রসীমা না হলেও অন্তত স্থলসীমার ব্যাপারটি নিষ্পত্তি হবে। তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ নিয়েও উভয় পক্ষ একটি চুক্তি স্বাক্ষর করবে।
কিন্তু যেদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এলেন, ঠিক সেদিন সকাল থেকে একটার পর একটা নেতিবাচক সংবাদ গণমাধ্যমে আসতে থাকল। প্রথম এল তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কথা। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হলেন না এবং সে দেশের পানিসম্পদ মন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরে এলেন না। আসলে পানির ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে খুবই জটিল বিষয়। অভিন্ন একটি নদী যখন দুই দেশের দীর্ঘ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন প্রতি পর্যায়ে উজানের মানুষের সঙ্গে ভাটির মানুষের দ্বন্দ্ব হয়। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেটুকু পানি পাবে, যেটুকু পানি উজানের দেশ ভারত ব্যবহার করার পর অবশিষ্ট থাকবে। আবার ভারতের মধ্যে উজানের রাজ্যগুলোর ব্যবহারের পর বাদবাকি পানি পশ্চিমবঙ্গ পাবে। তাদের অবশিষ্ট আবার পাবে বাংলাদেশ। সুতরাং সমাধান হচ্ছে, শুষ্ক মৌসুমে সমগ্র নদীর সব পানি ব্যবহারকারীর মধ্যে জনসংখ্যা, প্রয়োজন এবং সমতার নীতি বজায় রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ নদী ব্যবস্থাপনার চুক্তিতে উপনীত হওয়া। এ ধরনের জটিল সমস্যা চুক্তি করে সমাধানের জন্য প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সহানুভূতি, ন্যায়নীতি ও যুক্তিতে বিশ্বাস স্থাপন। এ রকম একটি পূর্ণাঙ্গ খতিয়ান ভারতের সরকারও করে নি। বাংলাদেশ সরকারও অতি আশাবাদ নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরে অগ্রসর হয়েছিল। ফলে শেষ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি ভেস্তে গেল।
বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর না হলে ট্রানজিট চুক্তি স্বাক্ষরও সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের লেনদেনের ক্ষেত্রে ভারতের সবচেয়ে জরুরি দাবি ছিল ট্রানজিট এবং নিরাপত্তা (বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীদের বাংলাদেশে স্থান না দেওয়া)। এবং বাংলাদেশের তরফ থেকে প্রধান প্রত্যাশা ছিল, পানি এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধাগুলো দূর করা। যেহেতু এবার সামগ্রিক একটি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল, সে জন্য উভয় পক্ষই লেনদেনের ভারসাম্য বজায় রেখেই অগ্রসর হতে চেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো দেশই খুব বেশি দিয়ে কম নিতে রাজি হবে না। তবে আমি মনে করি, সামগ্রিক নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আরও খতিয়ানের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে উভয়ের জন্য লাভজনক একটি চুক্তি করার দিকে অগ্রসর হতে হবে। পানির ক্ষেত্রে আমরা একটু বেশি লাভবান হব, আর ট্রানজিটের ক্ষেত্রে ভারত একটু বেশি লাভবান হবে– এ ধরনের সামগ্রিক ভারসাম্যপূর্ণ সমাধানে আমাদের উপনীত হতে হবে।
সীমান্ত সমস্যা, ছিটমহল সমস্যা, বাণিজ্য, নানা রকম সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক বিনিময় ইত্যাদি ক্ষেত্রে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক রচনায় যেটুকু ঐকমত্য স্থাপিত হয়েছিল, তা এই বিশেষ সংকটের কারণে স্থগিত থাকুক বা ভেঙে যাক, সেটা নিশ্চয়ই কারও কাম্য নয়।
সর্বশেষ ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, ট্রানজিট ও পানি ইস্যুতে কোন সুনির্দিষ্ট চুক্তি করা সম্ভব না হোলেও সীমান্ত, বানিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে কিছু চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে কিছু হতাশা সৃষ্টি হলেও বাংলাদেশের জনগন হাসিনা সরকারের ষ্ট্যন্ডে বিশেষত: শেষ মুহূর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের শক্তিশালী ভুমিকায় খুশিই হয়েছেন এবং হারানো জাতীয় ঐক্য কিছু পরিমাণে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আরো লক্ষ্যনীয় যে, ভারতীয় পত্র-পত্রিকাসমূহ আমাদের এই কঠোর অবস্থানের জন্য আমাদেরকে দায়ি করেন নি, বরঞ্চ তারা ছিলেন কেন্দ্রীয় পানি মন্ত্রী ও পশ্চিম বংগের মূখ্যমন্ত্রী ”দিদি”-র ব্যাপারেই বেশী সমালোচনামুখর!
এ ঘটনার শিক্ষা এই– উপযুক্ত প্রস্তুতি এবং দুই দেশের সংশ্লিষ্ট সবার মতামত ও অংশগ্রহণ ছাড়া হুট করে কেল্লা ফতে করার প্রবণতা কখনোই পূর্ণ সাফল্য দেয় না।

এম এম আকাশ: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন