বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১২

পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিবাদ : কিছু প্রাথমিক মন্তব্য


M-M-Akash-Edited111
পৃথিবী বদলে যাচ্ছে–একদম নতুন ধরনের ঘটনা ঘটছে পৃথিবীতে। তিউনিসিয়ায় একজন শিক্ষিত যুবক তার মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য (অর্থনৈতিক আয় বা নিরাপত্তার জন্য নয়) নিজের শরীরে আগুন জালিয়ে আত্মহত্যার পর সে আগুন সারা আরব বিশ্বে একের পর এক ছড়িয়ে পড়ল। অবিশ্বাস্য দ্রুত বেগে তা ছড়ালো। আবার একই সাথে বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রাণভোমরা আমেরিকান ফিন্যান্স পুঁজির সিংহাসন দখলের জন্য মাত্র শতাধিক নানারকম আমেরিকান মানুষ (যাদের মধ্যে প্রাক্তন বামপন্থী, কালো-সাদা, মানবাধিকারকর্মী, বেকার যুবকসহ গায়ক, বাদক সবাইই আছেন!) শ্লোগান তুললেন “ওয়ালস্ট্রিট দখল কর” আর সেই ডাক ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। পৃথিবীর ৯৫১টি শহরে (এমনকি আমাদের ঢাকাতেও!) হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ জনগণ পথে নেমে ঘোষণা করলেন: পৃথিবীতে আজ যে ১ শতাংশ ক্ষমতাধর ধনী পুঁজিপতি রয়েছেন তাদেরকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে। গণতন্ত্র হবে ৯৯ শতাংশের গণতন্ত্র। এর চেয়ে বিপ্লবী সহজ-সরল শ্লোগান গত পনের-বিশ বছরে এই জরাজীর্ণ বিবর্ণ সংকটজর্জর পৃথিবীতে এত সহজে আর উঠে আসেনি! তাই চমকে ভাবতে বসেছি একজন নিস্পৃহ সমাজবিজ্ঞানী এ সম্পর্কে প্রাথমিক কী কী পর্যবেক্ষণ পেশ করতে পারে। সমাজবিজ্ঞানী হিসাবে আমার এ সম্পর্কে মোট ১৬টি প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ রয়েছে। পাঠকদের সঙ্গে ‘শেয়ার’ করার জন্য নিচে এগুলিকে তুলে ধরছি।

প্রাথমিক পর্যবেক্ষণসমূহ
। প্রতিবাদটি শুরু হয়েছিল বিশ্ব পুঁজিবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে। সেই কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আমেরিকার “ওয়াল স্ট্রিট”। প্রধান শ্লোগান ছিল: “ওয়াল স্ট্রিল দখল কর!”
। প্রধান ইস্যু ছিল তিনটি: বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতি, বৈষম্য এবং বেকারত্ব। হয়তো এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওবামা প্রশাসনের লজ্জাকর দ্বিচারিতা: অপরাধী বহুজাতিক কোম্পানিগুলিকে ‘বেইল আউট’ করে দরিদ্র নাগরিকদের সামাজিক ভোগ তহবিল সংকোচিত করার লজ্জাকর নীতিকৌশল।
। কোনো স্থায়ী সংগঠন বা বৃহৎ রাজনৈতিক দল এই আন্দোলনকে সংগঠিত করে নি। এটা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত আত্মসংগঠিত একটি সামাজিক উদ্যোগ। এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরির কৌশল। এই সফল কৌশল এমন এক সামাজিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে যেখানে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন যে তিনিই এই আন্দোলনের কর্মী, তিনিই আবার এই আন্দোলনের জনক বা নেতা। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গানের মত: “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”।
। এই আন্দোলনটি হচ্ছে আগের অন্য সকল বিপ্লবী আন্দোলন থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের ভিন্নধর্মী একটি গণবিপ্লবী আন্দোলন। আগের সকল বিপ্লবী আন্দোলন তৈরি হয়েছে অনুন্নত পুঁজিবাদী দেশের বা প্রান্তিক পুঁজিবাদী দেশের “দুর্বল গ্রন্থিতে” এবং তার নেতৃত্বে থেকেছে সদা সর্বদা একটি “অগ্রগামী” সংগঠিত রেজিমেন্টেড বাহিনী। এবার বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অগ্রগামী শ্রেণীর শ্রেণীসংগ্রাম নয়, নানা মানুষের মধ্যে যারা “সমমতের অধিকারী” তাদের একত্রিত বিদ্রোহই জন্ম দিয়েছে এই নতুন আন্দোলনের। আর আন্দোলনটি জন্ম নিয়েছে এবং ছড়িয়ে পড়েছে একই সঙ্গে প্রায় সব উন্নত পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশের শহরগুলিতে। আক্ষরিক অর্থেই এই গণ-আন্দোলনের মূল চারিত্র্য হচ্ছে–জনগণের জন্য, জনগণের এবং জনগণের দ্বারা।
। এই আন্দোলন অসম্ভব হতো যদি ওয়েবসাইট, ফেসবুক মাইক্রো ব্লগ ও টুইটার, ইত্যাদি আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধার সমর্থন অনুপস্থিত থাকতো।
। এই আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে এর “নেতিবাচক” চরিত্র। নিঃসন্দেহে এই আন্দোলন হচ্ছে প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি তীব্র প্রতিবাদ। বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে একটি প্রতিবাদ বিন্দুতে এসে একত্রিত হয়েছেন। সে জন্য তাদের কোনো দীর্ঘমেয়াদী নিজস্ব যৌথ কর্মসূচী ছিল না। তারা জানতেন যে তারা পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপিত করতে চান কিন্তু কী দিয়ে তা তারা এখনো জানেন না। যেহেতু এই আন্দোলন এখনো স্বতঃস্ফুর্ত, অপরিকল্পিত, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-ক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্রসরমান সেহেতু এর ভবিষ্যৎও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত। যে কোনো শক্ত সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি এই আন্দোলনের ভেতরে নোঙর ফেলে এর হালটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পথে এগিয়ে নিতে পারে। তাই এই আন্দোলনের পরিণতি শুভও হতে পারে, অশুভও হতে পারে। অথবা আরো পেছনেও সমাজকে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি নৈরাজ্যেও পরিণত হতে পারে।
। প্রতিবাদটি ছিল আসলে আমেরিকান ফিন্যান্স পুঁজির প্রতীক “ওয়াল স্ট্রিটের” বিরুদ্ধে। প্রতিবাদটি শুরু হয়েছিল প্রায় এক মাস আগে ১৭ সেপ্টেম্বরে যখন মাত্র দুইশত প্রতিবাদকারী ওয়াল স্ট্রিটের কাছে একটি পার্কে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন প্রথমে কর্তৃপক্ষ একে কোনো আমল দেন নি। কিন্তু জেদী প্রতিবাদকারীরা দিনের পর দিন তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিলেন। ধীরে ধীরে তাদের সমর্থন বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কর্তৃপক্ষ আদেশ জারী করেন যে ১৪ অক্টোবরের মধ্যে তাদের সরে যেতে হবে। তারা ভয় না পেয়ে থেকে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। নিপীড়ন ও গ্রেপ্তারের সম্ভাবনাকে মেনে নিয়ে নৈতিক মানসিক বল নিয়ে অটল রইলেন। তখন কর্তৃপক্ষ এ যাত্রা পিছু হটতে বাধ্য হলো কারণ আইন অনুযায়ী তাদের সরানোর কোনো অধিকার রাষ্ট্রের নেই! এই ক্ষুদ্র বিজয়টি ইলেকট্রিক বার্তার মত সারা পৃথিবীতে যে উদ্দীপনার সৃষ্টি করল তারই পরিণতিতে এই দুইশত নাগরিক পৃথিবীব্যাপী ইতিহাসের স্রষ্টায় পরিণত হলেন।
। যেহেতু মূল প্রাথমিক শ্লোগানটি ছিল “ওয়াল স্ট্রিট দখল কর” সেহেতু এটি কোনো সংকীর্ণ ইস্যুভিত্তিক সংগ্রাম ছিল না। এটি ছিল ক্ষমতাসীন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার মত একটি বৈপ্লবিক সংগ্রাম। তাই একই ধারায় বৈপ্লবিক শ্লোগানগুলি উঠেছে একটার পর একটা–“দখল কর রোম”, “দখল কর টোকিও”, “দখল কর মাদ্রিদ”, ইত্যাদি। জনগণের কণ্ঠে এমন একটি মৌলিক প্রতীকী শ্লোগান এর আগে শোনা যায় নি।
। সকল সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠী : আদিবাসী নারী, কাল বর্ণের মানুষ, সমকামী বা উভলিঙ্গ মানুষ, প্রাক্তন যুদ্ধফেরৎ সৈনিক, শান্তি সংগ্রামী, হরেক রকম লোকেরা এতে এসে যোগ দিয়েছেন। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা অন্তর দিয়ে এই আন্দোলন সমর্থন করেছেন। তদুপরি শাসক শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত সৎ এবং অসন্তুষ্ট প্রতিনিধিরাও এই আন্দোলনের পক্ষে কোথাও কোথাও অবস্থান নিয়েছেন। সিডনির আন্দোলনে সেখানকার ব্যবসায়ী ইউনিয়ন যোগ দিয়েছেন। তাইওয়ানে তাদের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী ‘সেমি কন্ডাক্টর ম্যানুফেকচারিং এসোসিয়েশনের’ সভাপতি স্বয়ং এই আন্দোলনের পক্ষে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। বড় বড় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও বিভিন্ন অঙ্গনের জাতীয় তারকারা এই আন্দোলনকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছেন।
১০। প্রথম এই আন্দোলনের ডাকটা এসেছিল “১৫ অক্টোবর নেট” নামক ওয়েবসাইট থেকে। কিন্তু বিশ্ব যেন তার সমস্ত আবেগ ও কল্পনাশক্তি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসেছিল এই ডাকে সাড়া দেওয়ার জন্য। এটি ছিল একটি স্বার্থক সময়োচিত আহবান। বাদক এবং বাদ্যযন্ত্র উভয়ই তৈরি ছিলেন পবসুরকে সহযোগিতার জন্য। যদিও মনে রাখতে হবে এখানে একই লোক একই সঙ্গে বাদক এবং বাদ্যযন্ত্র উভয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
১১। এই সমগ্র আন্দোলনের একমাত্র ইতিবাচক সাধারণ শ্লোগানটি হচ্ছে: জনগণের ক্ষমতায়ন চাই এবং চাই প্রকৃত গণতন্ত্র।
১২। আমরা জানি সীমা অতিক্রম করলে পরম সহিষ্ণু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও হিংস্র হয়ে ওঠে। এখানেও তাই হয়েছিল। আমেরিকার “বস্টন দখল কর” মিছিল যখন “রোজ কেনেডি গ্রীনওয়েতে” পৌঁছায় ঠিক তখন দুপুর একটা ত্রিশ মিনিটে শত শত পুলিশ তাদের উপর নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মোবাইল ক্যামেরা এবং ইউ-টিউবের বদৌলতে সেই হিংস্রতার চিত্র তখন বাংলাদেশেই আমরা ডেস্কটপে দেখতে পাচ্ছি এবং আমাদের মনেও ক্ষোভের আবেগ জমতে শুরু করেছে। আন্দোলনের গতিবেগ স্তিমিত না করে আরো জড়িয়ে এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে।
১৩। এই ঘটনার পরেই নিউয়র্কের আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারা একটি “মিলিয়নেয়ার মার্চ” বা “কোটিপতিদের বিরুদ্ধে মার্চের” আয়োজন করবেন। প্রধানতঃ এখন ট্রেড-ইউনিয়ন বা শ্রমিক শ্রেণীর পরিবারগুলো এই সংগ্রামে এগিয়ে এসেছেন।
১৪। আজ এ কথা প্রমাণিত যে তারা গত অর্থনৈতিক সংকট থেকে ফায়দা লুটেছে। সেই সব বড় বড় বিনিয়োগ কোম্পানি ও ব্যাংকগুলিকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তার কেন্দ্রীয় বাজেট থেকে অঢেল ভর্তুকি প্রদান করেছেন। সে জন্যই বর্তমান রাষ্ট্রীয় বাজেট ঘাটতির মাত্রা দাঁড়িয়েছে ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার। বেচারা রাষ্ট্রপতি ওবামা ঘোষণা করেছেন যে কোনোভাবেই হোক প্রতিবছর তিনি ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বাজেট ঘাটতি কমাবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে? ওবামা যেটা করছেন তা হচ্ছে ব্যাপকভাবে তিনি সরকারের শিক্ষা ব্যয়, স্বাস্থ্য ব্যয়, সামাজিক বীমা সমর্থন ব্যয়, ইত্যাদি খাতে বাজেট কমাচ্ছেন। আর এসব ব্যয় সংকোচন প্রধানতঃ আঘাত করছে আমেরিকার নিম্নবিত্ত জনগণকে। এই জায়গাতেই ধীরে ধীরে জমা হচ্ছে বিক্ষোভ–প্রতিবাদের ঢেউ।
১৫। এই নতুন সামাজিক আন্দোলনটি দেশে-দেশে এখন পর্যন্ত সরকার, দাতা সংস্থা বা কর্পোরেশনের আর্থিক সমর্থন থেকে মুক্ত রয়েছে। যদিও একে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করার জন্য অনেক শক্তিই এখন তৎপর হবে। নিপীড়ন একে দমন করতে না পারলেও, প্রলোভন তা পারতেও পারে।
১৬। সামগ্রিকভাবে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে হয়তো এক নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। হয়তো একেই ভবিষ্যত বলা হবে “উত্তর-আধুনিক বিপ্লবের” এক নতুন যুগ। যা বা যেরকমই হোক না কেন, এ যুগের বিপ্লবের মর্মবাণী হবে সকল প্রকার অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার বিরোধিতা। গণতন্ত্রের অর্থ অবশ্য এখানে অনেক ব্যাপক হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রায়ন হবে এ যুগের প্রধান লক্ষ্যবস্তু।
এম. এম. আকাশ : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন